অজন্তাপ্রবাহিতা
একুশের ডিসেম্বর মাসে ডিগবয়ের বাড়ি গিয়ে হঠাৎ করেই অরুণাচল বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান হয়ে গেলো। একটা গাড়ি বুক করে সপরিবারে ২৩ ডিসেম্বর ভোর ছ'টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। টিংরাই বাইপাস ধরে একপাশে প্রশস্ত চা-বাগিচার মধ্যে দিয়ে পিচ রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি ছুটল। সকাল সাড়ে আটটার দিকে তালাপ বাগানে পৌঁছে 'লাকি সুইটসে' ছোলার ডাল, আলুর সবজি আর ময়দার পরোটা জলখাবার হিসেবে খেলাম। তার সঙ্গে খাঁটি দুধের স্পেশাল চা। কনকনে ঠান্ডায় আবার যাত্রা শুরু হলো। গন্তব্যস্থল ঢোলা-সদিয়া ব্রিজ।
ঢোলা সদিয়া ব্রীজ
এই ব্রিজের আরেকটি নাম ভূপেন হাজারিকা সেতু। এটি ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম সড়কসেতু। এই সেতু আসাম ও অরুণাচল প্রদেশ দুই প্রতিবেশী রাজ্যকে যুক্ত করেছে। ঢোলা থেকে সদিয়া পর্যন্ত ৯ কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা জুড়ে ব্রহ্মপুত্রের উপনদী লোহিত নদীর ওপরে ইংরেজি বর্ণমালা ‘এস’এর আকারে তৈরী হয়েছে এই সেতু। অরুণাচলে কোনও বিমান বন্দর নেই। এই সেতু চালু হওয়ার পরে অসম থেকে অরুণাচল মাত্র চার ঘন্টায় পৌছানো যায়। সেতুর ওপর কিছু ছবি তুলে আমরা এগিয়ে গেলাম সদিয়ার দিকে। ব্রীজের শেষে অরুণাচল চেক পোস্ট থেকে রাজ্যে প্রবেশ করার জন্য 'ইনার লাইন পারমিট' সংগ্রহ করে চললাম রোয়িং।
রোয়িং
অরুণ ও অচল। অরুণ অর্থাৎ উদীয়মান সূর্য আর অচল অর্থাৎ নিশ্চল পর্বত। সুপ্রাচীন কাল থেকে এই অরুণাচল সূর্য দেবতার বাসভবন। পাহাড়, নদী, জঙ্গল ও নানারকম বন্যপ্রাণীর সমন্বয়ে প্রাকৃতিক বৈচিত্রের বুনটে এক বিস্ময়কর স্থান।
আমাদের প্রথম গন্তব্য - দেওপানি ব্রীজ। 'ইজে' নদীর ওপর তৈরী এই সেতুটি দিবাং উপত্যকা জেলা এবং লোয়ার ডিবাং উপত্যকার উপরের এলাকার জন্য লাইফলাইন। পাহাড় ও নদীর অদ্ভুত সমন্বয়। মনোমুগ্ধকর নীরব
প্রকৃতিকে ক্যামেরাবন্দি করে এগোলাম ডাম্বুক গ্রামের দিকে। এক্ষেত্রে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হলো যেগুলো জেনে রাখা ভালো- প্রথমত অরুণাচলের মসৃণ রাস্তা, কোনও খানাখন্দ নেই। দূষণ মুক্ত বাতাস। প্রতিটি প্রশ্বাসে বুক ভরা অক্সিজেনের স্বাদ। দ্বিতীয়ত, রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ দেখাই যায় না। তৃতীয়ত, এখানে ফোনের নেটওয়ার্কের খুব সমস্যা। জিও বা বিএসএনএল ছাড়া অন্য কোনও পরিষেবা তেমনভাবে পাওয়া যায় না। সুতরাং গুগন ম্যাপ নয় বরং অভিজ্ঞ গাইডের ওপর ভরসা করাই ভালো।
ডাম্বুক
রোয়িং থেকে এগিয়ে চললাম ডাম্বুকের দিকে। অরুণাচল প্রদেশের নিম্ন দিবাং উপত্যকার একটি তহসিল বা জায়গা। পিকনিকের জন্য ডাম্বুক উপযুক্ত স্থান । বর্ধিষ্ণু তালুক, মূলতঃ কৃষি নির্ভর। ঢালে ছড়ানো ধাপ-চাষ। ধান -ভুট্টা - আনারস আর কমলার বাগান। মাঝে মাঝেই রাস্তায় স্থানীয় মহিলারা কমলা লেবু বিক্রি করছিলেন। এখানে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। বিয়েতে মেয়েরাই পুরুষ নির্বাচন করেন। ডাম্বুককে অরুণাচলের 'কমলা বাটিও' বলা হয়। কমলা,কলা ও স্থানীয় নুন-মিষ্টি বিহীন কলা পাতায় মোড়ানো চালের পিঠার একটা আলাদা আমেজ আছে। এরপর রওনা হলাম পাসিঘাটের উদ্দেশ্যে। বলে রাখি, এধরণের ট্রিপে সঙ্গে পর্যাপ্ত জল ও শুকনো খাবার রাখা প্রয়োজনীয়।
পাসিঘাট
মিঠে রোদের উষ্ণতা আর হালকা হিমেল হাওয়ার স্পর্শ উপভোগ করতে করতে সিয়াং নদীর উপর রানাঘাট ব্রিজ হয়ে পৌঁছে গেলাম মেঘ-বৃষ্টি-কুয়াশার দেশ পাসিঘাটে। সিয়াং নদীর তীরে অবস্থিত পাসিঘাটকে ‘অরুণাচল প্রদেশের প্রবেশদ্বার’ বলা হয়ে থাকে। ছোট্ট গ্ৰাম্য পরিবেশ। বাণিজ্যিক পর্যটনের হাত থেকে সুরক্ষিত আজকের জনাকীর্ণ শহুরে জীবনের ব্যস্ততা থেকে দূরে শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতির কাছাকাছি শান্ত মায়া-মেদুর মোহময় পরিমন্ডল। এর ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য অভিনব, কুন্ড সদৃশ। তিনদিকে উঁচু পর্বতমালা পরিবেষ্টিত স্থল। অসমের সমতল থেকে আসা বৃষ্টি বহনকারী মেঘ আকৃষ্ট করার জন্য পাসিঘাট আদর্শ। সিয়াং নদীর উৎপত্তি ভারতে নয়, চিনে। চিনের তিব্বত অংশের বুরাং কাউন্টির হিমালয় অংশের আংসি হিমবাহ থেকে বেরিয়ে ইয়ার্লাং সাংপো গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই নদী অরুণাচল প্রদেশ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। ভারতে এই নদীর নাম দিহাং বা সিয়াং। পাসিঘাটের পর থেকে সিয়াং নদী 'প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র' নামে আসামের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। পাহাড়ি নদী বড়ই রহস্যময়ী। সে দূর থেকে সরু বেনী বাঁধার ফিতের মতো, কাছে এলে প্রবল, শান্ত স্রোতস্বী কখন যে কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করে তা কেউ বলতে পারে না। তার এই স্বভাবের জন্যই স্থানীয়রা 'পাগলা নদী' বলে ডাকে। স্ফটিকের মতো নীল জল কুলু-কুলু শব্দে বয়ে যাচ্ছে। নদীর দু’ধারের জংগল, দুরের পাহাড়,মাথার ওপর গাঢ় নীল আকাশ। দূরে রানাঘাট ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। এ নয়নাভিরাম দৃশ্য ছেড়ে সেখান থেকে ফিরে আসতে মন চাইবে না। পাসিঘাটের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্য এটি একটি জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক পর্যটন স্থান হিসাবেও সমানভাবে জনপ্রিয়। এখানে বাস করা 'পাসি' এবং 'মিনয়ং' উপজাতিরা উত্তর পূর্ব ভারতের প্রাচীনতম দুটি উপজাতি। এদের বহমান সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচার সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জানতে হলে অবশ্যই আপনাকে আসতে হবে আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে 'সুলুং উৎসব'-এর সময়। নাচে গানে ঐতিহ্যে আপনার মন জয় করে নেবে সুলুং। এবার এগিয়ে গেলাম শিরকী ওয়াটারফলের দিকে।
শিরকী ওয়াটারফল
শিরকী ওয়াটারফল অসম্ভব দুঃসাহসিক একটি ট্যুরিস্ট পয়েন্ট। মুখ্য জলধারার কাছে পৌঁছনোর রাস্তা দুর্গম ও বিপজ্জনক। রীতিমতো হামাগুড়ি দিয়ে অর্ধেক পথ পেরিয়ে জলধারার একটি পয়েন্টে পৌঁছে দেখা গেল বিশাল একটি পাথর। তার গা ঘেষে কুলকুল করে জল বয়ে যাচ্ছে। এতটাই স্বচ্ছ জলধারা যে তার জলে খেলতে থাকা মাছগুলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওই পিচ্ছিল পাথর পেরিয়ে আর উপরে যাওয়ার সাহস হয়নি। বলে রাখি, অরুণাচল বেড়াতে এলে সঙ্গে 'ওয়াটার প্রুফ ট্রেকিং সু' এবং ট্রেকের পোশাক পড়ে আসা প্রয়োজন।
বোদাক ভ্যালি
পূর্ব সিয়াং জেলার পাসিঘাট শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে বোদাক ভ্যালি। ঠিক যেন পাহাড়ের কোলে স্বর্গ। জলছবির মতো দৃশ্যপট। প্রশস্ত রাস্তা। পাশে সিয়াং নদী এবং শান্ত বাতাস। সে এক স্বর্গীয় আনন্দের অনুভূতি। রাস্তায় কিছু মিথুনের দেখা পাওয়া গেল। অরুণাচলের উপজাতির সমৃদ্ধির প্রতীক মিথুন। সঙ্গে দেখা গেল, সিয়াংয়ের গভীর গিরিখাতের ঝুলন্ত বাঁশের সাঁকো। সম্পূর্ণ বাঁশ দিয়ে তৈরি। দু’পাশে টান করে বাঁধা রয়েছে পাহাড়ের গায়ে। এই ঝুলন্ত বাঁশের সাঁকোর টানেই ছুটে গিয়েছিলাম বোদাক ভ্যালি। পথের উঁচু বাঁক থেকে এই সাঁকো সরু দোলনা বলে মনে হয়। নিচে আপনমনে গর্জন করে চলেছে সিয়াং নদী। তারই হাওয়ায় দুলছে সেই সাঁকো। সামান্য অসাবধান হলেই হলেই সিয়াং নদীর খরস্রোতে সলীলসমাধি নিশ্চিত। প্রায় হাজারের বেশি সিঁড়ি পার হয়ে বাঁশের সাঁকোর কাছে পৌঁছতে হয়।
পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে বানানো সিঁড়ি। কোথাও আবার শুধুই মাটির ঢাল। যেমন পিচ্ছিল তেমনই বিপজ্জনক। অরুণাচল, ভারতের পূর্বদিকে বলে তাড়াতাড়ি সন্ধে নামে। রোদের তাপ একঝটকায় কমে গিয়ে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। প্রায় সাড়ে পাঁচশো সিঁড়ি পেরনোর পর কিছু স্থানীয় মানুষের দেখা পাওয়া গেল। তবে অবাক করার বিষয় হলো, যে সিঁড়ি পার হতে আমাদের কালঘাম ছুটছিল, সেই সিঁড়ি ওঁরা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে অনায়াসে চলাফেরা করছে। থাকতে না পেরে রহস্য জিজ্ঞেস করতেই, সহাস্যে জবাব দিলো, সেই ছোটবেলা থেকেই এই সিঁড়ি পেরিয়ে ঝুলন্ত সাঁকোর উপর তাদের যাওয়া-আসা। দিনের শেষ আলোটুকু সম্বল করে কিছু স্থানীয় মহিলা বাজার গুছাতে শুরু করেছে। তাদের থেকে কিছু কমলা ও পাহাড়ি আদা কিনে রওনা হলাম পাসিঘাট শহরের দিকে। শেষে ব্রহ্মপুত্রের উপরে থাকা বগীবিল পার হয়ে ডিব্রুগড় পৌছালাম।
জরুরী তথ্যঃ
১) অরুণাচলের ইনারলাইন পারমিটের জন্যে যে কেউ অনলাইনে(http://arunachalilp.com/index.jsp) আবেদন করতে পারেন। কলকাতায় সল্টলেকের অরুণাচল ভবন থেকেও পারমিট দেয়। প্রত্যেকের এককপি করে সচিত্র পরিচয়পত্র, এককপি পাসপোর্ট সাইজের ছবির প্রয়োজন হয়।
২) অরুণাচল ঘোরার সবথেকে ভাল সময় হল নভেম্বর থেকে মে মাসের প্রাথম সপ্তাহ। নভেম্বরে অ্যাডভেঞ্চার ফেস্টিভালের সময় গেলে হোমস্টে বুক করে যাওয়া ভাল। www.tripadvisor.in এ পাসিঘাটে থাকার জন্য ভালো হোটেলের খোঁজ পাওয়া যাবে।
৩) কলকাতা থেকে বর্তমানে পাসিঘাটের সরাসরি উড়ান চালু হয়েছে। গুয়াহাটি বিমানবন্দর অথবা ডিব্রুগড় বিমানবন্দর থেকে গাড়ি বুক করে অরুণাচল পৌঁছানো যায়।
৪) অরুণাচলের রাস্তায় বিশেষ কোনও পেট্রলপাম্প নেই। বিমানবন্দর থেকে যাবার পথে গাড়িতে যথেষ্ট জ্বালানি ভরে নিতে হবে।
৫) আদিবাসিদের গ্রাম ও বাড়িতে গেলে ওদের আচার-আচরণ বা জীবনযাপনের শৈলী নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করা উচিত হবে না।
৬) একটি ছোট কালো মাছি যা স্থানীয়ভাবে ডিম ডিম (এছাড়াও ড্যাম দম ) বলে। তার হাত থেকে বাঁচার জন্য শরীরের খোলা অংশে ওডোমস ব্যবহার করুন ।
৭) এই রাস্তায় বড় গাড়ি এবং ভাল কন্ডিশনের গাড়ি নেওয়া প্রয়োজন।
https://t.co/ffgiOExW1h https://t.co/ffgiOExW1h
— KOLKATA PRIME TIME (@KolkataTime) January 23, 2020
https://t.co/P0QcQzHBTS https://t.co/P0QcQzHBTS
— KOLKATA PRIME TIME (@KolkataTime) January 23, 2020
Kolkata Prime Time আমাদের নিউজ পোর্টাল সর্বশেষ প্রস্তাব ও ব্রেকিং নিউজ হয়.
Owner : DIBYENDU GHOSAL
স্বত্বাধিকারী : দিব্যেন্দু ঘোষাল
Contact: 9232119011
E-mail : kolkatapritime@gmail.com
Address :Kolkata Prime Time, S.P. PALLY, REGENT PARK, KOLKATA- 700093
©️ সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত